সম্প্রতি একটি টকশোতে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা আলেম বিতার্কিক ও টকশো বিশেষজ্ঞ ড. মুফতি এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী। এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলেম এবং ইসলাম সম্পর্কে সুগভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী। নিজ ধর্ম ইসলাম ছাড়াও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, ভূগোল, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কেও তার পান্ডিত্যের প্রমাণ মেলে। তিনি মূলত পীর বংশে জন্মগ্রহণকারী একজন গদিনশীন পীর ও আলেম। গত ফ্যাসিস্ট আমলে হাক্কানী আলেমগণ যখন অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন ও দুর্বিচারের কবলে পড়ে কারারুদ্ধ , এবং আয়না ঘরে গুম অবস্থায় আবদ্ধ সেই সময়ে বিভিন্ন টকশোতে নাস্তিকদের সাথে তার যে বাদানুবাদ এবং তর্ক বিতর্ক তা বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভীষণ গ্রহণযোগ্যতা পায় ও প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশের কিছু ক্ষতিকর বুদ্ধিজীবী যারা বাংলাদেশে বসবাস করে অন্য দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে এবং নিজের মুখেই অন্যের শেখানো বুলিতে কথা বলেন অথবা স্ক্রিপ্টেড কথা বলেন, সেইসব বাম-রাম ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী সাহেবের যে তর্ক-বিতর্ক তথ্যবহুল আলোচনা ও বাক-বিতন্ডা, তা সত্যিই ইসলাম ও মুসলমান সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ধর্ম শাস্ত্রের বাইরে ও আধুনিক বিভিন্ন শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করার কারণে এই সমস্ত নাস্তিক এবং মুরতাদ তার সাথে টকশোতে বিতর্কে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তিনি নিজেকে সুন্নি মুসলমান হিসেবে দাবি করেন। এবং তিনি মনে করেন একমাত্র তার আদর্শ এবং তার পূর্বপুরুষদের আদর্শ ইসলামের সঠিক আদর্শ। অন্যান্য সকলেই কম বেশি ভুল আদর্শের উপরে প্রতিষ্ঠিত। এরকম মনে করেন বলেই তিনি একটি টকশোতে বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক স্কলার দ্বীনের দাঈ ড. মিজানুর রহমান আজহারীকে কাফের ফতোয়া দেন। বিষয়টি নিয়ে আমার পক্ষে সুগভীর তথ্যবহুল বা অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণধর্মী লেখা সম্ভব নয়। কারণ আমি আলেম নই। এ বিষয়ে আমার কখনো পাঠক্রম ছিলো না। আমি পড়ালেখাও জানিনা। তবে মনে করি ৫ই আগস্ট পরবর্তীতে এই ধরনের অভিধা প্রয়োগ আলেম সমাজের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টি করবে। শান্তির পথে বিভেদ সৃষ্টি করবে, যার ফলে পক্ষ-বিপক্ষ দল-উপদলের সৃষ্টি হবে এবং নিম্নমানের কোন্দল অনিবার্য। এটি অবশ্যই মুসলিম সমাজের জন্য একটি ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে পরিগণিত। যাকে তাকে যখন তখন কাফের ফতোয়া দেওয়া যায় কি না বিষয়টি আলেমগণ ও ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী সাহেব আরো গভীরভাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ভেবে দেখবেন বলে মুসলমান সমাজ মনে করে। আর আমরা মনে করি এদেশের ৯০% মুসলমানদের ভিতরে বিভাজন এবং কোন্দল সৃষ্টি হলে তা অমুসলিমদের উপরে প্রভাব ফেলে। কারণ তখন তৃতীয় পক্ষ সোচ্চার হয়। কিছু মানুষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। নানান ধরনের বিশৃঙ্খলা এবং সমস্যার সৃষ্টি করে বাংলাদেশে। তাই এই ধরনের একটি মহামারী রকম সুযোগ সৃষ্টি করে ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী নিজেকে নিষ্পাপ দাবি করতে পারেন কি না, এটি একটি বড় প্রশ্ন। দিনের দাঈরা কথায় কথায় ফতোয়া দিয়ে কাফের অভিধা দিয়ে নিজেকে অন্যের থেকে অনেক বড় প্রমাণ এবং প্রকাশ করার মানসিকতা নিশ্চয়ই দাঈর দুর্দশা হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ কাফেরের থেকে মুনাফিক বেশি। যদিও সকল মুনাফিকই কাফের তবে কিছু কিছু কাফের মুনাফিক নন। অতএব কোন একজন দ্বীনের দাঈকে বা আলেমকে কাফের ফতোয়া দিলে ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টি হলে, বিদ্বেষ বিতর্ক সৃষ্টি হলে, জিঘাংসা চরিতার্থ হলে, মুনাফিকের মতো কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়টি আরো গুরুত্বপূর্ণ। ড. মিজানুর রহমান আজহারী তিনি শান্তিকামী আলেম হিসেবে সুপরিচিত। সাধারণত কারো নাম উল্লেখ করে তিনি সমালোচনা করেন না। তার মাহফিলে বিষোদগার সৃষ্টি করেন না। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বাংলাদেশের সকল মানুষ সুন্দর সময় অতিবাহিত করুক এটাই তার কামনা বলেই মনে হয়। তিনি স্বল্প আয়তন জীবনে যতগুলি মাহফিল করেছেন খুব একটা কাউকে কাফের ফতোয়া দিয়েছেন তা দেখা যায় না। কাফের ফতোয়া দিয়ে যাকে কাফের বলা হলো তিনি যদি কাফের না হন তাহলে যিনি ফতোয়া দিলেন তার পরিণতি কি হবে? মহাগ্রন্থ আল কুরআনে সূরা কাফিরুন, সূরা মুনাফিকুন দু-রকমই রয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন সুরাতে কাফের এবং মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস গ্রন্থে সূচিপত্রগুলো দেখলে অন্তত এটা পাওয়া যায় না: কি কি করলে কাফের হবেন? এরকম আলাদা কোনো চ্যাপ্টার পাওয়া যায় না। তাহলে বোঝা গেল নবী করীম সাঃ কাফের ফতোয়া দেওয়ার জন্যই ইসলামের প্রচার করেন নি। তা যদি তিনি করতেন, তাহলে তার হাদিস গ্রন্থে অন্তত কি কি করলে কাফের হবেন তার একটা চ্যাপ্টার পাওয়া যেত। এ সমস্ত নাই। কারণ তিনি তো শান্তির দূত। তিনি তো রহমাতুল্লিল আলামিন। তিনি তো পৃথিবীবাসীর উপর রহমত। যিনি রহমত তিনি যদি একের পর এক কাফের ফতোয়া দিতে থাকেন তাহলে মুসলমান হবে কে? তাহলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ কোত্থেকে আসবে? কাফের ফতোয়া দেওয়ার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। বরং ধর্মীয় বিভাজন এবং বিভেদ উসকে দেয়। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে ইসলাম ও মুসলমান এবং বাংলাদেশের জন্য উপর উল্লেখিত দুইজন আলেমেরই প্রয়োজন। এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী সাহেব দয়া করে আরো কয়েকবার ভাবুন, ড. মিজানুর রহমান আজহারী সাহেব কি সত্যিই কাফের হয়ে গেছেন? যদি তা না হন, তাহলে কোরআন ও হাদিসের আলোকে আপনার কি হতে পারে তাও একবার ভাবুন। আরো অনেকবার ভাবুন। তারপর প্রথমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং গণমাধ্যমে ভুল স্বীকার করুন। এই রমজান মাসে আল্লাহ পাক সকলকেই হেদায়েত করুন। আসুন সমস্ত আগ্রাসীর বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করি। এদেশের মুসলমানরা যদি বিভাজিত না হন তাহলে হিন্দু খ্রিস্টান বৌদ্ধ সকলেই ভাল থাকবেন। এজন্যই এত কথা বলা এবং লেখা। আপনারা ভালো থাকুন। আমাদেরকেও ভালো রাখুন। কেয়ামত পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন থাকুক। আলেম সমাজ যেদিন আরো বেশি কোন্দলে নিজেদেরকে নিয়োজিত করবে। খন্ড-বিখন্ড হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে উপদলে বিভাজিত হবে, সেদিন এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিলীন হবে। তাই চলুন, দেশের স্বার্থে বিভাজন ভুলে সকলের সাথে মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করি। আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রিয় মাতৃভূমির অবস্থান, এটাই কল্পনা করি।
লেখক: কলামিস্ট।